নমস্কার
অভিনব একাডেমীতে আপনাদেরকে স্বাগত জানাই। এই পর্বে আমরা জানবো একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ন টপিক ‘রাজিয়া’ সম্পর্কে। আমি আমার সাধ্যমতাে চেষ্টা করেছি এই পােষ্টে রাজিয়া র সমস্ত দিকগুলি তুলে ধরার। এছাড়া বিভিন্ন টপিকের উপর মকটেস্ট দিতে নীচে দেওয়া আমাদের টেলিগাম গ্রুপ বা হােয়াটস অ্যাপ গ্রুপগুলির যে কোন একটিতে যােগদান করতে পারেন।
প্রতি সপ্তাহের মকটেস্টের জন্য নীচে দেওয়া Telegram গ্রুপে জয়েন করতে পারেন
টেলিগ্রাম গ্রুপ এ যোগদান করার জন্য - Click Here
রাজিয়া সুলতান
By- Manas Adhikary
ইতিহাসে এক আলােড়ন সৃষ্টিকারী নাম হল সুলতানা রাজিয়া। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক। সুলতানা রাজিয়া ১২০৫ সালে জন্মগ্রহন করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈনিক হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ পিতা ইলতুতমিশ ছিলেন দিল্লির সুলতান মৃত্যুর আগে সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনােনয়নের বিষয়ে ইলতুতমিশ বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। কারন তিনি তাঁর যে পুত্রকে সুযােগ্য বলে মনে করতেন সেই নাসিরুদ্দিন মামুদ ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাতেই মারা যান। বাকি যে দুই পুত্র ছিল তারা কেউই সিংহাসনে বসার যােগ্য ছিলেন না। ফলে ইলতুতমিশ মৃত্যুর আগে তাঁর কন্যা রাজিয়াকে রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘােষনা করেন। ইলতুতমিশের মৃত্যুর আগে তাঁর এই ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরান করে তখনকার রক্ষনশীল ও ঈর্ষাকাতর মুসলিম আমির-ওমরাহগন। তাঁরা নারীর শাসনকে ইসলামে অবৈধ বলে ঘােষনা করেন। ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর নারীবিদ্বেষী আমির-ওমরাহগন রাজিয়ার বিরােধিতা শুরু করেন। তাদের যুক্তি ছিল ইলতুতমিশের পুত্র থাকার কারনে তাঁর কন্যা উত্তরাধিকারী হতে পারে না। ফলে রাজিয়া তাঁর অধিকার ছেড়ে দিলে তাঁর সৎভাই রুকুনুদ্দিন ফিরােজ সুলতান হিসাবে সিংহাসনে বসেন। এই সময় ইলতুতমিশের কয়েকজন ক্রীতদাস খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা ‘বন্দেগান-ই-চেহেলগান’ বা বিখ্যাত চল্লিশ চক্র নামে পরিচিত ছিল৷ কাউকে সুলতান বানানাে বা কাউকে সুলতানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কর্তৃত্ব তারা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। তাঁদের সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করা হত যে, "King makers and King Breakers"। যাইহােক খুব শিগগিরই রুকুন উদ্দীন ফিরােজ শাসক হিসাবে ব্যর্ততার পরিচয় দেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতি হলে আমির-ওমরাহগন রাজিয়াকে সুলতানরূপে মেনে নিতে রাজি হন। কিন্তু রুকুন উদ্দীনের মাতা রাজিয়াকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে এবং সর্বসমক্ষে ষড়যন্ত্রের কথা উঠে এলে সভাসদরা রাজিয়া সুলতানার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। ১২৩৬ খ্রীষ্টাব্দে রাজিয়া সিংহাসনে আরােহন করেন। সিংহাসনে আরােহন করেই রাজিয়া বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও রাজিয়া বিরােধী চল্লিশ চক্রের অন্যতম নেতা জুনাইদি রাজিয়ার সিংহাসন লাভের বিরােধীতা করতে থাকেন৷ মুলতান, লাহাের, বদায়ূন, হানসি প্রদেশের আঞ্চলিক শাসনকর্তারা দিল্লি অবরােধ করে রাজিয়ার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তােলে। রাজিয়ার চারিদিকে এক ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল তৈরী হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে রাজিয়া সুস্থ মস্তিষ্কে সমস্যা সমাধানের দিকে অগ্রসর হন। তিনি সুকৌশলে বিভিন্ন বিদ্রোহী আমির এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরী করেন এবং বিরােধী পক্ষের মহম্মদ সালারি, ইজুদিন, কবির খান প্রমুখ ব্যক্তিকে নিজপক্ষে আনতে সক্ষম হন। মাল্লিক মহম্মদ জুনাইদি পলাতক অবস্থায় নিহত হন। বিদ্রোহ দমন প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দীন সিরাজ বলেন, “লক্ষনাবতী থেকে দেবল ও দামরিলা পর্যন্ত সমগ্র দেশের মালিক ও আমীরগন তাঁর আনুগত্য ও প্রভুত্ব স্বীকার করে নেন। দেশে আবার শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে৷ শাসনকার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে রাজিয়া একটি অনুগত গােষ্ঠী তৈরি করার উদ্যোগ নেন। তিনি তুর্কি অভিজাতদের দ্বারা গঠিত চল্লিশ চক্র ভেঙে দিয়ে একটি কেন্দ্রীভুত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদে অতুর্কি মুসলমানদের বসিয়ে তিনি তুর্কি অভিজাতদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। মুহজাব উদ্দিনকে তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং কুতুব উদ্দিন হাসন ঘুরিকে তিনি প্রধান সেনাপতির পদে নিয়ােগ করেন। রাজিয়ার এইসব তুর্কি বিরােধি প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহনের ফলে তুর্কি অভিজাতরা রাজিয়ার বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হন। রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে সুলতানা রাজিয়া স্বাভাবিক কারনেই নিজেকে পর্দার অন্তরালে আবদ্ধ রাখতে পারেননি। তাঁকে প্রকাশ্য দরবারে উপবেশন করতে হত। দরবারে বসার সময় তিনিপুরুষের পােশাক পরিধান করতেন। কোমরে ঝােলাতেন। কোষবদ্ধ তরবারি। পুরুষের পােশাকে সজ্জিত হয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে ঘােড়ার পিঠে চড়ে তিনি সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করতেন। এছাড়াও তিনি সুলতানদের মত তাঁর মুদ্রায় ইমদউল নিশান বা প্রতিভাময়ী মহিলা এই শব্দগুলি খােদাই করেছিলেন। এইসব কার্যকলাপের জন্য দিল্লির উলেমা ও মৌলভীরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাজিয়া বিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়৷
আলতুনিয়ার বিদ্রোহ
দিল্লী আমির-ওমরাহ ও অভিজাতরা রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে রাজিয়ে সেই সমস্ত ষড়যন্ত্রকারীদের দমন করার উদ্যোগ গ্রহন করেন। কিন্তু অভিজাতদের নেতা বলবন ও রাজপরিবারের প্রধান কর্মচারী আইতিগিনের সহায়তায় ভাতিন্দার শাসনকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন আলতুনিয়া রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষনা করেন। রাজিয়া তার সেনাপতি জামাল উদ্দিন ইয়াকৎ খাঁকে সঙ্গে নিয়ে ভাতিন্ডা দূর্গ অভিযান করেন। কিন্তু যুদ্ধে ইয়াকুৎ খাঁ নিহত হন এবং রাজিয়া আলতুনিয়ার হাতে বন্দী হন।
আলতুনিয়ার হাতে রাজিয়া বন্দী হলে তার ভাই বাহরাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরােহন করেন। কিন্তু বাহরাম শাহ আলতুনিয়াকে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ না দেওয়ায় আলতুনিয়া ক্ষুব্ধ হন। আলতুনিয়ার এই ক্ষোভের সুযােগকে কাজে লাগিয়ে রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিবাহ করে দিল্লীর সিংহাসন পূর্নদখলের চেষ্টা করেন এবং দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু বাহরাম শাহের সেনাবাহিনীর কাছে তাঁরা পরাজিত হয়ে ভাতিন্দায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। পথিমধ্যে সুলতানী বাহিনীর হাতে ১২৪০ খ্রীস্টাব্দে আলতুনিয়া ও রাজিয়া উভয়েই নিহত হন।
অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
১) রাজিয়া কে ছিলেন?
- ইলতুতমিশের কন্যা, পরে দিল্লীর সুলতান হয়েছিলেন।
২) দিল্লীর প্রথম মহিলা শাসক কে ছিলেন?
- সুলতানা রাজিয়া।
৩) ইলতুতমিশ মৃত্যুর আগে কাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে মনােনীত করে গিয়েছিলেন?
- তাঁর কন্যা রাজিয়াকে
৪) ইলতুতমিশের মত্যর পর কে দিল্লীর সিংহাসনে বসেছিলেন?
- রুকন উদ্দীন ফিরােজ
৫) রুকন উদ্দীন ফিরােজ সম্পর্কে রাজিয়ার কে ছিলেন?
- সৎভাই।
৬) রাজিয়া কবে দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন?
- ১২৩৬ সালে।
৭) রাজিয়া যখন সিংহাসনে বসেন কে তাঁকে মারার ষড়যন্ত্র করেছিলেন?
- রুকুন উদ্দীনের মাতা।
৮) রাজিয়া যখন সিংহাসনে বসেন তখন চল্লিশ চক্রের কোন অন্যতম নেতা রাজিয়ার সিংহাসন লাভের বিরােধীতা করেন?
- জুনাইদি
৯) বিরােধী পক্ষের কোনাে কোন নেতৃবৃন্দকে রাজিয়া নিজের পক্ষে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন?
- মহম্মদ সালারি, ইজুদিন, কবির খান।
১০) কার সম্পর্কে ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দীন সিরাজ মন্তব্য করেছিলেন - ‘লক্ষনাবতী থেকে দেবল ও দামরিলা পর্যন্ত সমগ্র দেশের মালিক ও আমীরগন তাঁর আনুগত্য ও প্রভুত্ব স্বীকার করে নেন।‘
- সুলতানা রাজিয়া
১১) চল্লিশ চক্র ভেঙে দেওয়ার প্রথম প্রচেষ্টা কে করেছিলেন?
- রাজিয়া (চল্লিশ চক্রের সম্পূর্ন উৎখাত করেন গিয়াস উদ্দিন বলবন)
১২) কোন মহিলা শাসক পুরুষের পােশাক পরিধান করতেন?
- সুলতানা রাজিয়া
১৩) কোন শাসক তাঁর মুদ্রায় ‘ইমদউল নিশান বা প্রতিভাময়ী মহিলা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন?
- রাজিয়া
১৪) কে রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষনা করেন?
- আলতুনিয়া
১৫) আলতুনিয়া কোথাকার শাসক ছিলেন?
- ভাতিন্ডা প্রদেশের
১৬) বিদ্রোহী আলতুনিয়ার সহযােগী কে ছিলেন?
- বলবন ও রাজপরিবারের প্রধান রাজকর্মচারী আইতিগিন
১৭) চল্লিশ চক্রের কোন অন্যতম নেতা প্রথমে রাজিয়ার পক্ষ অবলম্বন করলেও পরবর্তী রাজিয়ার বিপক্ষে চলে যান?
- গিয়াস উদ্দীন বলবন।
১৮) বলবন কীসের জন্য রাজিয়ার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল?
- ইয়াকুৎ নামক এক হাবশি ক্রীতদাসের সাথে রাজিয়ার ঘনিষ্ঠতায় (ঐ ইয়াকুৎ কে রাজিয়া সেনাপতির পদে বসিয়েছিলেন)
১৯) রাজিয়ার প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন?
- কুতুব উদ্দিন হাসন ঘুরি (সেনাপতি-জামাল উদ্দিন ইয়াকৎ)
২০) রাজিয়ার প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?
- মুহজাব উদ্দিন।
২১) কোন বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে রাজিয়ার সেনাপতি নিহত হন এবং রাজিয়া বন্দী হন?
- ভাতিন্দা প্রদেশের শাসক আলতুনিয়ার বিদ্রোহ
২২) রাজিয়া আলতুনিয়া কাছে বন্দী হলে কে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন?
- তাঁর ভাই বাহরাম শাহ।
২৩) আলতুনিয়া বাহরাম শাহের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কেন?
- বাহরাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে বসে আলতুনিয়াকে কোন গুরুত্বপূর্ন প্রশাসনিক পদ দেননি বলে।
২৪) রাজিয়া কাকে বিবাহ করেন?
- আলতুনিয়াকে
২৫) কাকে সাথে নিয়ে রাজিয়া দিল্লীর সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন?
-আলতুনিয়াকে
১) দাস বংশীয় কোন সুলতান দাস ছিলেন?
- রাজিয়া (অনেকে ভুল করে বলবনকে সঠিক উত্তর হিসাবে নির্বাচিত করে। কিন্তু তাহা সঠিক নহে। কারন গিয়াস উদ্দিন বলবন প্রথম জীবনে দাস ছিলেন। ইলতুতমিস তাকে দাস হিসাবে কিনে নিয়েছিলেন)
ধন্যবাদ
ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন টপিক সম্বন্ধে পড়তে - Click Here
মধ্য যুগের ইতিহাসের বিভিন্ন টপিক সম্পর্কে পড়তে - Click Here
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন টপিক সম্পর্কে পড়তে - Click Here
ভারতের ইতিহাসের পিডিএফ ডিটেইলস পেতে Click Here