নমস্কার
অভিনব একাডেমীতে আপনাদেরকে স্বাগত জানাই। এই পর্বে আমরা জানবো একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ন টপিক ‘প্যারিসের বিদ্রোহ ও বাস্তিল দুর্গের পতন’ সম্পর্কে। আমি আমার সাধ্যমতাে চেষ্টা করেছি এই পােষ্টে প্যারিসের বিদ্রোহ ও বাস্তিল দুর্গের পতন র সমস্ত দিকগুলি তুলে ধরার। এছাড়া বিভিন্ন টপিকের উপর মকটেস্ট দিতে নীচে দেওয়া আমাদের টেলিগাম গ্রুপ টিতে যােগদান করতে পারেন।
প্রতি সপ্তাহের মকটেস্টের জন্য নীচে দেওয়া Telegram গ্রুপে জয়েন করতে পারেন
টেলিগ্রাম গ্রুপ এ যোগদান করার জন্য - Click Here
প্যারিসের বিদ্রোহ ও বাস্তিল দুর্গের পতন
Set By - Manas Adhikary
ফ্রান্সের জাতীয় সভায় যে সময় বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেনী, অভিজাতদের মতই একই অধিকার লাভ করার সংগ্রামে ব্যস্ত ছিল, ঠিক সেই সময়ে প্যারিস নগরীর সাধারন মানুষের মধ্যে এক বিপ্লবী চেতনা জেগে ওঠে৷ একই সময়েই ফ্রান্সের বুকে নেমে এসেছিল এক দুর্ভিক্ষের কালাে ছায়া। খাদ্যের অভাব দেখা দেওয়ায় গ্রাম থেকে দলে দলে ক্ষুধার্ত মানুষ শহরে চলে আসে খাদ্য পাওয়ার আশায়। সেসময় সামান্য রুটির দাম এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, একজন শ্রমিককে তাঁর মজুরির ৮৮ শতাংশ শুধুমাত্র রুটির জন্য ব্যয় করতে হত৷ গ্রাম থেকে শহরে আগত চালচুলােহীন মানুষ এবং শহরে থাকা প্রায় সাড়ে সাতলক্ষ সর্বহারা মানুষজন (এদেরকে সাঁ কুলােৎ বলা হত) একত্রে শুরু করল শহর জুড়ে লুটপাট, দাঙ্গা-হাঙ্গামা৷ বুর্জোয়া শ্রেনীর লােকজনের বিক্ষোভ ছিল কেবলমাত্র ভােটাধিকার নিয়ে, কিন্তু এইসব সর্বহারা সাধারন মানুষের বিক্ষোভের কারন ছিল খাদ্যাভাব।
চারিদিকে যখন বিক্ষোভের আগুনে প্যারিস নগরী ক্ষতবিক্ষত ঠিক তখনই রাজা ষােড়শ লুই শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে প্যারিসের চারপাশে ভাড়াটিয়া জার্মান সৈন্য মােতায়েন করেন এবং ১৭৮৯ সালের ১১ জুলাই সাধারন মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়, তৃতীয় এস্টেটের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সংস্কার বুদ্ধিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ জ্যাক নেকারকে বরখাস্ত করলে জনতা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
বাস্তিল দুর্গের পতন
সভ্যতার ইতিহাসে যেসমস্ত ঘটনা কোনাে নতুন যুগের সূচনার রণডঙ্কা বাজিয়েছে কালে কালে, সেগুলির মধ্যে ‘বাস্তিল দুর্গের পতন’ হলাে অন্যতম। প্যারিস নগরীর পুর্বদিকে অবস্থিত এই দুর্গটি ছিল ফরাসি রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক। ইংল্যান্ডের সাথে শতবর্ষের যুদ্ধ চলাকালীন প্যারিস শহরের পুর্বদিকের প্রবেশপথটি ইংরেজদের আক্রমন থেকে রক্ষা করার জন্য ১৩৭০-৮০ এর মধ্যে কোন একটি সময়ে বাস্তিল দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। এই বাস্তিল দুর্গের অপর নাম ছিল সেন্ট-অ্যান্টোইন৷ ১৪১৭ সালে এটিকে রাষ্ট্রীয় কারাগার হিসাবে ঘােষনা করা হয়। ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই, যাঁরা তাঁর বিরােধিতা করত তাঁদেরকে এই কারাগারে বন্দি করে রাখত। ১৬৫৯ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে বাস্তিল দুর্গটি একটি রাষ্ট্রীয় শাস্তিকেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে৷ বিচারে বা বিনা বিচারে রাজতন্ত্রের বিরােধী বিভিন্ন ব্যক্তিকে এখানাে বন্দী করা হত৷ এমনকি প্রখ্যাত লেখক ও দার্শনিক ভলতেয়ারকেও এই বাস্তিল দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়েছিল৷
১৭৮৯ সালের ১১ জুলাই রাজা ষােড়শ লুই অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করলে, গ্রাম থেকে আসা সর্বহারা মানুষ এবং শহরে থাকা সর্বহারা মানুষ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরদিন অর্থাৎ ১২ জুলাই প্যারিসের রাস্তায় প্রতিবাদী জনতার ঢল নেমে যায়। রাজসৈন্যরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে বিক্ষুব্ধ মানুষজন এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে রাজসৈন্যরা তাদের পথ থেকে ভয়ে দুরে সরে যেতে বাধ্য হয়। বিক্ষুব্ধ জনগন পন্যের উপর কর আরােপ করা, খাদ্য ও মদের দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী বেশীরভাগ শুল্ক পােষ্টগুলি পুড়িয়ে দেয়৷ বিভিন্ন খাদ্য, বন্দুক ও রসদ এর মজুতকরা স্থানে লুঠপাট শুরু করে প্যারিসের জনগন।
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই এই লুঠতরাজ চরম আকার ধারন করে। হােটেল দেস ইনভালাইডস থেকে ৩২০০০ মাস্কেট এবং কিছু কামান বাজেয়াপ্ত করে বিক্ষোভকারীরা। এই হােটেল দেস এর কমান্ড্যান্ট ২৫০ ব্যারেল বারুদ নিরাপদে রাখার জন্য সেগুলিকে বাস্তিল দুর্গে পাঠিয়ে দেয়। খবর পেয়ে বিক্ষোভকারীরা বাস্তিল দুর্গকে ঘিরে ফেলে, বাস্তিলে সঞ্চিত বিপুল পরিমান বারুদ এবং অস্ত্রশস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দাবি করতে থাকে। বাস্তিলের তৎকালীন গভর্নর ছিলেন বার্নার্ড-রেনে-দে-লাউনাই৷ তিনি দেখেন যে বাস্তিল দুর্গের চারপাশে বিক্ষুব্ধ মানুষের ভীড় ক্রমশ বাড়ছে। তিনি ভয় পেয়ে জমায়েতে গুলি না চালানাের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মীমাংসার জন্য জনতার মধ্য থেকে দুজন প্রতিনিধিকে দুর্গে আহ্বান জানান। আলােচনার সময় দীর্ঘায়িত হলে বাইরে জমা ভীড়ও অধৈর্য এবং চঞ্চল হয়ে ওঠে। একসময় তাদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ভিতরে যাওয়া তাদের প্রতিনিধিদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুপুর দেড়টা নাগাদ ভীড়ের একাংশ বাস্তিল দুর্গের বাইরের উঠোনে প্রবেশ করে পরিখার সঙ্গে দুর্গের সংযােগকারী একটি সেতুকে ভেঙে দেয়৷ এইসময় বাস্তিলদুর্গের সৈন্যরা তাদের থামার নির্দেশ দিলেও বিক্ষোভকারীরা তাদের কথা না শুনে তারও এগিয়ে যেতে থাকে এবং দ্বিতীয় ব্রিজটি ভেঙে ফেলে। উপায়ান্তর না দেখে লাউনাই তাঁর অঙ্গীকার ভেঙে গুলি চালানাে নির্দেশ দেন। এই গােলাগুলিতে প্রায় একশােজন আক্রমনকারী প্রান হারান। বিকাল ৩ টের সময় ফ্রেঞ্চ গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নিয়ে দুটি কামান সহযােগে রানক্ষেত্রে অবতীর্ন হয়। ফলে বিবাদ আরও চরম আকার ধারন করে। অবশেষে বিকাল ৫টা নাগাদ বাস্তিলের গভর্নর দে-লাউনাই দুর্গের সৈনিকদের গুলি চালানাে বন্ধ করতে বলেন এবং আত্মসমর্পন করেন। লাউনাইকে আটক করে বিদ্রোকারীরা টানতে টানতে নিয়ে যায় হােটেল ডি ভিলের দিকে। সেখানে নিয়ে তাঁকে বিভৎসভাবে প্রহৃত করা হয় এবং পরে একের পর এক ছুরিকাঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। লাউনাই এর মৃত্যু হলে বিদ্রোহীরা তাঁর মুন্ডচ্ছেদ করে তার মাথা শুলে গেঁথে তুলে ধরা হয় উপরের দিকে। এইসময় বাস্তিলের গ্যারিসন সৈন্যের তিনজন অফিসারও এই ভীড়ের হাতে নিহত হয়। দীর্ঘকালের যে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রিক শাসন তার অবসান ঘটেছিল রাজতন্ত্রের প্রতীক এই বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে এবং প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল৷
অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
১) বাস্তিল কী?
- একধরনের দূর্গ।
২) বাস্তিল দূর্গের পতন হয়েছিল কবে?
- ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই
৩) কোন বিপ্লবের মাধ্যমে বাস্তিল দূর্গের পতন ঘটে?
- ফরাসি বিপ্লব
৪) ফ্রান্সের কোন রাজার আমলে বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটে?
- রাজা ষােড়শ লুই
৫) ফ্রান্সে বাস্তিল দূর্গের পতনের ক্ষেত্রে কারা মুখ্য ভূমিকা গ্রহন করেছিল?
- সাঁ-কুলােৎ
৬) সাঁ-কুলােৎ কাদের বলা হত?
- প্যারিসের রাস্তায় চালচুলােহীন ভবঘুরে মানুষজনদেরকে
৭) বাস্তিল দূর্গে পতনের আগে গ্রামের মানুষজন শহরে এসে ভীড় জমিয়েছিল কেন?
-খ্যাদ্যের সন্ধানে।
৮) তখনকার দিনে রুটির দাম কেমন ছিল?
- খাদ্যাভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে রুটির জন্য একজন শ্রমিককে তার মজুরির ৮৮% শতাংশ ব্যয় করতে হত।
৯) বুর্জোয়া শ্রেনীর লােকজনরা কিজন্য বিক্ষোভ করেছিলেন?
- কেবলমাত্র ভােটাধিকার নিয়ে
১০) সাধারন মানুষের বিক্ষোভের কারন কী ছিল?
- খাদ্যাভাব।
১১) কারা খাদ্যের জন্য প্যারিস শহরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করেছিল?
- সাঁ-কুলােৎরা
১২) বাস্তিল দূর্গ কীসের প্রতীক ছিল?
- ফরাসী রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক
১৩) বাস্তিল দূর্গে অপর নাম কী?
- সেন্ট-অ্যান্টোইন।
১৪) বাস্তিল দূর্গ কবে নির্মিত হয়েছিল?
- ১৩৭০-৮০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে কোন একটি সময়ে।
১৫) বাস্তিল দূর্গ কীজন্য নির্মিত হয়েছিল?
- শতবর্ষের যুদ্ধের সময় ইংরেজবাহিনী যাতে আক্রমন না করতে পারে তার জন্য।
১৬) পরবর্তীকালে বাস্তিল দূর্গ কীসে পরিনত হয়েছিল?
- রাষ্ট্রীয় কারাগার
১৭) কোন প্রখ্যাত লেখক ও দার্শনিককে বাস্তিল দূর্গে বন্দী করে রাখা হয়েছিল?
-ভলতেয়ার
১৮) রাজা ষােড়শ লুই কবে সাধারন মানুষের কাছে জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করেন?
- ১৭৮৯ সালের ১১ জুলাই।
১৯) বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে কোন হােটেলের কম্যান্ডার ২৫০ ব্যারেল আরুদ* বাস্তিল দূর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন?
- হােটেল দেস।
২০) বাস্তিল দূর্গের পতনের সময় বাস্তিল দূর্গের গভর্নর কে ছিলেন?
- বার্নার্ড-রেনে-দেলাউনাই (De Launey)।
২১) বার্নার্ড-রেনে-দে-লাউনাই যখন বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানাের নির্দেশ দেন তখন বিক্ষোভকারী পক্ষ নিয়ে কারা দুটি কামান সহযােগে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ন হয়েছিলেন?
- ফ্রেঞ্চ গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা
২২) বাস্তিল দুর্গের পতনের সময় বিক্ষোভকারীরা কার মাথা কেটে শুলে গেঁথে উপরের দিকে তুলে ধরেছিল?
- বার্নার্ড-রেনে-দে-লাউনাই এর
২৩) কোন ঘটনার পর ফরাসী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল?
- বাস্তিল দুর্গের পতনের পর।
২৪) বাস্তিল দুর্গের পতনের সময় সেখানে কতজন বন্দী অবস্থায় ছিলেন?
- ৭ জন
২৫) ফরাসি বিপ্লবের সূচনা বলে কাকে ধরা হয়?
- বাস্তিল দুর্গের পতনকে
২৬) বাস্তিল দুর্গের পতনের সাথে সাথে কারা দেশত্যাগ করতে থাকেন?
-ফ্রান্সের রাজার সাহায্যকারী অভিজাত সম্প্রদায়রা।
২৭) কোন ঘটনার পর প্যারিসের শাসনভার বুর্জোয়াদের হাতে চলে গিয়েছিল?
-বাস্তিল দুর্গের পতনের পর
২৮) কোন ঘটনার পর প্যারিস শহর ঘিরে থাকা সেনাবাহিনীকে রাজা যােড়শ লুই সরিয়ে নেন?
- বাস্তিল দুর্গের পতন।
২৯) কোন ঘটনার পর প্যারিস কমিউন গঠিত হয়?
- বাস্তিল দুর্গের পতনের পর
৩০) প্যারিস কমিউন কী?
- প্যারিসের অস্থায়ী পৌর পরিষদ (বাস্তিল দুর্গের। পতনের পর বিপ্লবীরা নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে এই প্যারিস কমিউন গঠন করে)
৩১) বাস্তিল দুর্গের পতনের পর প্যারিস নগরীর শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিপ্লবীরা কী গঠন করেছিল?
- ন্যাশনাল গার্ড নামক এক জাতীয় রক্ষীবাহিনী৷
৩২) ফান্সের জাতীয় দিবস কোনটি?
- ১৪ জুলাই (বাস্তিল দুর্গের পতনের দিন)
এই অধ্যায় সম্পর্কিত MCQ মকটেস্ট দেওয়ার জন্য নীচে দেওয়া ছবিটির উপর ক্লিক করুন।
ধন্যবাদ
ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন টপিক সম্বন্ধে পড়তে - Click Here
মধ্য যুগের ইতিহাসের বিভিন্ন টপিক সম্পর্কে পড়তে - Click Here
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন টপিক সম্পর্কে পড়তে - Click Here
ইউরোপের ইতিহাসের বিভিন্ন টপিক সম্পর্কে পড়তে - Click Here